- বিদ্যুৎ রাজগুরু
লিও টলস্টয় বলেছিলেন, ‘মানুষের অজ্ঞানতার মধ্যে সরকারের শক্তি নিহিত রয়েছে সরকার সেটা জানে। সেজন্য সরকার সত্যিকারের জ্ঞান চর্চার বিরোধিতা করে।’ সেই সংস্কৃতি আজও সমানে চলছে৷
রাজ্যের সাধারণের স্কুলে এত ছুটি, অভিযোগ উঠছে, রাজ্যে ছুটিসংস্কৃতি ক্ষয়িষ্ণু সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। সরকার পোষিত স্কুলে কার্যকরী শিক্ষণ দিবস কমে যাচ্ছে হুহু করে। কর্মসংস্কৃতি বিষয়ে গালভরা কথা আজ কথার কথা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গাফিলতির দিকটি সর্বত্র আলোচিত।
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের লাগাতার ছুটির আদেশনামা দেখে এমন আলোচনা প্রবল। কোনও ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত বৈচিত্র্যের তোয়াক্কা না করেই সারা রাজ্যের সঙ্গে একই সারিতে ফেলে উত্তরবঙ্গের স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে কি সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রা করে দেওয়া হচ্ছে? রাজ্যের অন্যান্য অংশের জলহাওয়ার সঙ্গে উত্তরের জলহাওয়া গুলিয়ে ফেলে গ্রীষ্মাবকাশ সর্বজনীন করা কতটা যুক্তিযুক্ত, ভাবতে হবে।
প্রচণ্ড গরমের দিনগুলিতে স্নেহশীল শিক্ষার্থীদের কথা ভাবাটা অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু ছুটির আদেশনামাও আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তনও করা উচিত। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, শিলিগুড়ির সঙ্গে মালদা, বালুরঘাট, রায়গঞ্জের আবহাওয়ার অমিল প্রচুর। সেটাও ভাবতে হবে ছুটি ঘোষণার সময়।
ভূমিরূপের বৈচিত্র্য সঙ্গে জলবায়ুর বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে স্কুলগুলোর পরিচালন সমিতি ছুটির তালিকা প্রস্তুত করে। একটা সময় ছুটির তালিকা প্রস্তুতিতে দারুণভাবে অগ্রাধিকার পেত এলাকার আবহাওয়া, জলবায়ু ও কৃষিনির্ভর গ্রামীণ এলাকার শস্য রোপণের বিষয়টি। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বিদ্যালয় শিক্ষার বার্ষিক ছুটির তালিকা তৈরির রেওয়াজ ছিল। গ্রামীণ কৃষিপ্রধান অঞ্চলে বর্ষার সময়টা ছুটি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভৌগোলিক, আর্থসামাজিক অবস্থা কিংবা কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কোনও দিকটিকেই মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। ছুটি সংস্কৃতি, সরকারি নীতি আর ভোগসর্বস্ব সমাজ সাধারণের স্কুল ব্যবস্থার বুনিয়াদকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করছে।
সাধারণ স্কুলগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ দিন-দিন কমে যাচ্ছে। স্কুল রুগ্ন হয়ে পড়ছে। সাধারণের স্কুলের ছাত্রছাত্রী বেসরকারি স্কুলে ছুটছে। অবৈতনিক শিক্ষা সাধারণের কাছে সোনার পাথরবাটি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সাধারণ দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাও বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে। সাধ আর সাধ্যের ফারাকে তারা হাঁপিয়ে উঠছে। বিষয় শিক্ষকের অভাব যেমন রয়েছে, তেমন শিক্ষাবহির্ভূত কাজে খানিকটা পঞ্চায়েতের কাজের মতো শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের যুক্ত থাকতে হচ্ছে। পেশাকে আর পাঁচটা চাকরির মতো মানসিকতায় নিয়ে নেওয়ায় ঘরের দরজায় বদলির বায়না বাড়ছে রোজ। চটজলদি নিয়োগ না হওয়ায় স্কুলগুলি পড়ছে অথই জলে।
‘এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে’ এমন আশঙ্কায় উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালা বন্ধ করে দিয়েছিল হীরক রাজার দেশে’র রাজা। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রচার করা হয়েছিল ‘লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে’ তার কি প্রতিচ্ছবি দেখছি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে? আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সম্প্রতি ঘোষিত ছুটির আদেশনামা হাতের তালুতে উত্তপ্ত ভারী ধাতবখণ্ডের মতো প্রশ্ন করছে, সাধারণের স্কুল কি ছুটির স্কুলে পর্যবসিত হতে চলেছে?
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক)