- প্রবীর ঘোষাল
অযোধ্যায় রাম মন্দির দর্শন সেরে কাছেই চায়ের দোকানে এসে বসেছি। সন্ধ্যা হয়েছে। কামারহাটির বাসিন্দা মাঝবয়সি মহাদেব চক্রবর্তী সপরিবারে চায়ের তৃষ্ণা মেটাতে দোকানে এলেন। আলাপচারিতায় জানলাম, বছরখানেক আগে স্কুল শিক্ষকের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া মহাদেববাবু আদ্যন্ত বামপন্থী মানুষ। এবিটিএ’র সংগঠনে চাকরি জীবনে সক্রিয় ছিলেন। বেশ মিশুকে পরিবার।
মাস্টারমশাই নিজে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু স্ত্রী-কন্যার তাগিদে রাম মন্দির দর্শন করতে এসেছেন। স্ত্রী কণিকা সরকারি চাকুরে। মেয়ে সুস্মিতা সদ্য কলেজ ছেড়ে, উচ্চশিক্ষার জগতে পা রেখেছে। শিক্ষিত পরিবার। তবে, মহাদেববাবুর মতো তাঁর স্ত্রী-কন্যা বামপন্থী নন, বরং ঘোরতর বিরোধী। তাঁদের কথাবার্তায় হিন্দুত্বের প্রভাব যথেষ্ট। অযোধ্যায় আরাধ্য দেবতার মন্দির নির্মাণের জন্য মা-মেয়ে মুক্তকণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করলেন।
এবার এল আমাদের আলোচনার আসল অংশ। লোকসভা ভোট। পশ্চিমবঙ্গে কী হবে? তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি নাকি বাম-কংগ্রেসের লড়াই? কারা হবে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ? গরম গরম সিঙ্গাড়া আর মশলা দেওয়া দুধের সুস্বাদু চায়ে চুমুকের সঙ্গে জমে উঠল ভোটের আলোচনা। বাঙালি বলেই হয়তো ভোট নিয়ে আমাদের এত মাতামাতি।
মাসখানেক আগে অযোধ্যা-বেনারস-এলাহাবাদ-বিন্ধ্যাচল বেড়াতে গিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, কোথাও ভোট নিয়ে অবাঙালিদের মধ্যে আলোচনায় আগ্রহ দেখিনি। এমনকি অযোধ্যার রাম মন্দির নিয়েও যোগী আদিত্যনাথের খাসতালুকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় কোনও উন্মাদনা লক্ষ করিনি। ভোট নিয়ে কোনও দেওয়াল লেখাও চোখে পড়েনি।
চায়ের দোকানে আমাদের আলোচনায় ফিরে যাই। মাস্টারমশাই বোঝাতে চান, ‘বাম-কংগ্রেস জোট এবার চমকে দেবে। অন্তত তিন-চারটে আসন তারা পাবেই।’ মহাদেববাবুর স্ত্রী রীতিমতো ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘দেখো, ৪২টা না পেয়ে যায়।’ সরাসরি না বললেও, মা-কন্যার ইঙ্গিত ছিল, তাঁদের মতামত বিজেপির পক্ষে। নানা ইস্যু তুলে বামেদের পাশাপাশি দুজনেই তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করছিলেন। এই সময় মহাদেববাবু মন্তব্য করলেন, ‘ওরা জানেন তো আগে সিপিএম ছিল। এখন পদ্মফুলে নাম লিখিয়েছে।’
এইসব আলোচনার মধ্যেই আরেক বাঙালি পর্যটক দম্পতি এলেন এবং চায়ে পে চর্চায় যোগ দিলেন। নারায়ণ চৌধুরী আর তাঁর স্ত্রী নির্মলাদেবী। ষাটোত্তীর্ণ দম্পতির বাড়ি বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে। ছোটখাটো ব্যবসায়ী। তাঁদের ভোট নিয়ে সাফ কথা, ‘মমতা এবং জোড়াফুলের জয়জয়কার হবে।’ কারণ? লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের নানা জনমুখী প্রকল্প। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ‘গ্রামীণ আবাস যোজনা’ এবং ‘১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে’ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বাংলার প্রতি অবিচার।
এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, তখন বাংলায় দু’বার মোদি প্রচারে এসে গিয়েছেন। মমতাও উত্তরবঙ্গজুড়ে প্রচার করে পুরুলিয়া পর্যন্ত চলে গিয়েছেন এবং মোদির মতো মমতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, এবারের ভোটে বাংলায় তাঁরা কোন কোন ইস্যুকে প্রচারে হাতিয়ার করবেন। সিএএ এবং এনআরসি ছাড়া দুই পক্ষের বাকি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলি মোটামুটি প্রাদেশিক। অর্থাৎ একান্তই পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব।
এমনিতে অন্য দলের থেকে আগেই পূর্ণাঙ্গ প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করে ভোটের মাঠে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি দফায় দফায় প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করেও, তালিকা শেষ করতে পারেনি। আর কংগ্রেস-বামপন্থীদের অবস্থা তো বেশ কাহিল। সব কেন্দ্রে দু’পক্ষের সমঝোতা হয়নি। তার উপর আইএসএফের সঙ্গে তো কংগ্রেস-বামেদের শেষপর্যন্ত রফাই হল না।
তৃতীয় পক্ষের এই টালমাটাল অবস্থাই বলে দিচ্ছে, এবারও এরাজ্যের লোকসভা ভোটে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। তাহলে কি সিপিএম-কংগ্রেস এবং আইএসএফের কোনও ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে। অন্তত উত্তরবঙ্গের মালদা এবং দক্ষিণবঙ্গে তো আছেই। ভোট কাটাকাটির অঙ্কে বাংলায় প্রায় ১০-১২টি লোকসভার আসনের ভাগ্য নির্ভর করছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষই নেবে আপারহ্যান্ড। অর্থাৎ তারা নিজেরা আসন না পেলেও, নিজেদের নাক কেটে যে কোনও প্রতিপক্ষের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারে।
পাঁচ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি আসন দখল করে, রাজনীতির জগতে চমক সৃষ্টি করেছিল বিজেপি। সেই ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছিল, অধিকাংশ আসনেই বামেদের ভোটের সিংহভাগ গিয়েছিল গেরুয়া শিবিরের পক্ষে। মুর্শিদাবাদ, মালদার বাইরে উত্তরবঙ্গে তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গেও সবক’টি জেলায় কংগ্রেসের ভোটব্যাংকেও থাবা বসায় বিজেপি। তাতেই তাদের জয়ের জায়গাটা বেড়ে যায়।
কিন্তু দু’বছর পরে বিধানসভায় সেই জনসমর্থন পদ্মফুলের প্রার্থীরা ধরে রাখতে পারেননি। ভোটের ফলে দেখা গেল, বামেদের ভোটের একটা অংশ ফিরে গিয়েছে বামেদের ঘরেই। কংগ্রেসেরও কিছুটা তাই। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেসের অভাবনীয় ফল করতে অসুবিধা হয়নি। বাম এবং কংগ্রেস ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে একটি আসন না পেলেও, ভোট কেটে অন্তত ৭০টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় সুনিশ্চিত করেছিল।
এ রাজ্যে মমতার শক্তপোক্ত ভোটব্যাংক হল, মহিলা আর মুসলিম। প্রায় দুই দশক ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের দাপটে রাজত্ব করার আসল উৎস হল ওই ভোটব্যাংক। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পর মমতা আরও কয়েকটি জনমুখী প্রকল্প গ্রহণ করেন। তার মধ্যে সুপারহিট হয়েছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। বিগত বিধানসভার ভোটে মহিলা ভোটের সিংহভাগ জোড়াফুলের পক্ষে যাওয়ার আসল রহস্য হল এই প্রকল্প। এবার মহিলাদের হাতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের আরও বেশি টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা মমতা ভোটের আগেই করে দিয়েছেন। ফলে, ভোটের দিন বুথের দরজা খোলার আগেই মহিলাদের বিরাট লাইন দেখা যাবে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত তৃণমূল শিবির। প্রচারের প্রথম দিন থেকেই মমতা বলতে শুরু করেছেন, ‘আমি না থাকলে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও থাকবে না।’
এবার আসি মুসলিম ভোটের কথায়। এ রাজ্যে কমবেশি ৩০ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। উত্তরবঙ্গে মালদার দুটি আসন এবং দক্ষিণবঙ্গে অধিকাংশ আসনে মুসলিম ভোট ফ্যাক্টর। ২০১১ সালের আগে থেকেই এই ভোটারদের বড় অংশ মমতাকেই তাঁদের ভরসা হিসাবে আঁকড়ে ধরতে শুরু করেন। সেই বন্ধন বিধানসভা ভোট পর্যন্ত অটুট ছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি, আজও মুসলিম ভোট মমতা ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারে না। এর কারণ, অবশ্যই বিজেপির দাপাদাপি। গেরুয়া শিবির যত দাপট দেখাবে, ততই সংখ্যালঘুরা ভয় পাবে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ নেবে।
তবে বিজেপি-জুজু এবারের ভোটে এ রাজ্যে কতটা কাজ করবে, সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান পোড়খাওয়া বামপন্থী নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায়। ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সম্পাদক নরেনবাবু বলছিলেন, ‘আমরা মুসলিম সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিতে তাদের বিজেপির ভয় দেখাই। আমার মনে হচ্ছে, এবার এই জুজু ততটা কাজ করবে না।’ তবে সিপিএমের এক নেতার মতে, ‘আইএসএফের সঙ্গে জোট হলে হয়তো, কিছুটা মুসলিম ভোট আমাদের পক্ষে ফিরে আসত। কিন্তু সেই জোট তো হল না।’
তৃণমূল কংগ্রেসের তরুণ নেতা এবং পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর দাবি, ‘মুসলিম ভোট এবারও একচেটিয়া পাবে তৃণমূল কংগ্রেস। আসলে ভোট হবে উন্নয়নের পক্ষে। দিদি গত ১০-১২ বছর ধরে যেসব উন্নয়নের কাজ করেছেন এবং করে চলেছেন, তাতে কোনও জাতধর্মের বিচার নেই। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী থেকে শুরু করে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুযোগসুবিধা যাঁরা পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন, তাতে কে কোন জাতের কিংবা কোন দলের তার কোনও বিচার হয় না। জাতিধর্ম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উন্নয়নভোগী রাজ্যবাসী এবারও দু’হাত তুলে তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দেবেন।’
আর বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর চ্যালেঞ্জ, ‘দুর্নীতি থেকে শুরু করে স্বজনপোষণ, অত্যাচারই হবে ভোটে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ইস্যু। মোদি-ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ে উড়ে যাবে সব পক্ষ। বিজেপির ফল হবে চমকপ্রদ।’
প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তরবঙ্গে বিজেপি ভালো ফল করলে দক্ষিণবঙ্গে সেই ফল ধরে রাখতে পারবে তো? নাকি গতবারের মতো এক ছবি দেখা যাবে বাংলায়? অযোধ্যায় বর্ধমানের সমুদ্রগড় ও কামারহাটির পরিবারগুলোর কথা মনে পড়ছে।
(লেখক সাংবাদিক)