আশিস ঘোষ: ইয়ে তো ট্রেলার হ্যায়।
আমাদের ছোটবেলায় সিনেমার ট্রেলার কাকে বলে জানতাম না। তখন তো এখনকার মতো ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। আমরা দেওয়ালে লাগানো পোস্টারে জানতে পারতাম কবে কোথায় কোন সিনেমা ‘আসিতেছে, আসিতেছে, আসিতেছে।’ ফলে ট্রেলার কী বস্তু তা জানতে পেরেছি অনেক পরে। অভিধানে বলে, আগামী ছবির নমুনা হিসাবে প্রদর্শিত খণ্ড চলচ্চিত্র। দু’ঘণ্টার পিকচার হলে বড়জোর মিনিট তিন-চারের ট্রেলার।
যখন দেশের প্রধান সেবককে সভায় সভায় হাত নাড়িয়ে ‘ইয়ে তো ট্রেলার হ্যায়’ বলতে শুনি, তারপর খানিকটা হুমকির সুরে ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত’ বলেন তখন হাততালির চোটে বাকি কথা চাপা পড়ে যায়। কীসের ট্রেলার, পিকচারই বা কীসের সে এক-এক জায়গায় এক-এক রকম। ট্রেলার বলতে কী কাজ হয়েছে, পিকচার মানে কী কাজ করা হবে। এখন যত লোকসভার ভোট এগোচ্ছে ততই ট্রেলার এবং পিকচার দেখানোর বহর বাড়ছে। ভোটের মরশুম তো নানারকম স্বপ্ন ফেরি করারও মরশুম। দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার ১০০ দিন পর থেকেই মোদি পিকচার দেখানোর কথা বলে চলেছেন অক্লান্তভাবে।
এখন দশ বছর পরেও আসল পিকচার যে শুরু হয়নি তা জানিয়ে চলেছেন তিনি। লোকের একটাই প্রশ্ন, ট্রেলারেই যদি দশ বছর চলে যায় তবে আসল পিকচারটা শেষ হবে কবে? এবার মোদি ভোটের বাজারে নেমেছেন অনেক হিসেব কষে। এর আগে তাঁর বহু প্রতিশ্রুতি জুমলা বলে বহু লোকের কাছে ধরা পড়ায় এবার তিনি ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, অমৃতকালের দোহাই দিয়ে আগামী ৫০ বছরের পিকচার বিলি করছেন তিনি। প্রথমে ২০৪৭ সাল, তারও পরে ‘৫০ বছরের গল্প’। যদি তা দেখতে হয় তবে ততদিন পদ্মফুলে ছাপ মেরে চলতেই হবে।
প্রথমবার যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন মোদির স্লোগান ছিল ‘অচ্ছে দিন’। কত কী শুনতাম তখন। বিদেশের ব্যাংকে কালা ধন যা জমা আছে তা ফেরত এনে প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে পনেরো লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম বেশি হবে। বছরে ২ কোটি চাকরি হবে। তারপর এল রাত আটটার সেই নোটবন্দি। তখন বলা হয়েছিল, কালো টাকা উদ্ধার হবে। সন্ত্রাস বন্ধ হবে। এক ধাক্কায় বিনা নোটিশে পাঁচশো, হাজার টাকার নোট বাতিল করা হল। তারপর কী হল? বাতিল টাকা প্রায় পুরোটাই ফেরত এল ব্যাংকে। বহু খরচ করে ছাপানো নতুন দু’হাজারি নোট শেষমেশ তুলে নিয়ে আসা হল বাজার থেকে।
তারও পরে করোনা অতিমারির সময় লাখ লাখ পরিযায়ীর অসহ্য কষ্ট দেখতে হল আমাদের। কাজ হারালেন কত মানুষ। করোনা টিকার সরকারি সার্টিফিকেটে সবাই দেখতে পেলেন প্রধান সেবকের সহাস্য মুখ। নোট বদলের লাইনে দাঁড়িয়ে বেঘোরে মরতে হল শতাধিক সাধারণ মানুষকে। ট্রেলারে এরই পাশাপাশি আছে তিন তালাক রদ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার সংকল্প এখনও স্মৃতিতে টাটকা।
এবং অবশ্যই রাম মন্দির। বহু ধুমধাম করে তার দ্বারোদঘাটন হল। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অযোধ্যাকে ঝাঁ চকচকে অত্যাধুনিক শহর করা হল। এরপর কাশী, মথুরা বোধহয় পিকচারের জন্য তুলে রাখা হয়েছে। বাকি আছে দেশজোড়া অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। যেহেতু মোদি থাকলে সবই মুমকিন তাই পিকচারে একে একে সবই আসবে। তিনি যেহেতু অন্য দল ভাঙিয়ে গরিষ্ঠতা বানাতে চৌকশ, তাই দরকারি সংখ্যাও জোগাড় হয়ে যাবে, ভক্তরা নিশ্চিত।
দেশের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে মোদি অ্যান্ড কোম্পানির সুমধুর সম্পর্ক অতি সম্প্রতি নির্বাচনি বন্ড কাণ্ডে প্রকাশিত। পিকচারে আরও কী থাকতে পারে তা কিছুটা পরিষ্কার, বাকিটা কালের গর্ভে। পিকচার বাকি। তবে তার মধ্যে আছে হয়তো সংবিধান পালটানো। দেশজুড়ে এক ভোট। তারপর হয়তো ঘোষিত লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র। দেশজুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অভিযান। বাজার যত তেতে উঠছে ততই সুর কেমন যেন বদলে যাচ্ছে প্রধান সেবকের কণ্ঠস্বরে। এবার বিরোধীদের ‘চুন চুনকে সাফ’ করার, পাশের দেশে ‘ঘর মে ঘুসকে মারনা’ র মতো হুংকার শুরু হয়েছে।
‘ওম শান্তি ওম’ সিনেমায় শাহরুখ খানের এই ডায়ালগ মোদির গলায় আরও অনেকবার শুনতে হবে সন্দেহ নেই। তবে ট্রেলারে যা দেখা গেল তাতে পিকচার কী হবে তার কিছু নমুনা পাওয়া গেল না কি?