- শেষাদ্রি বসু
আঞ্চলিক বা সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে ইতিহাসের সালতামামিতে সম্পৃক্ত থাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, যাঁরা তাঁদের অঞ্চল বা সর্বভারতীয় পটভূমিতে নিজেদের বয়ান তৈরি করতে পারেন। নিজের শহর বা গ্রামের কথা তুলে ধরতে তো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিরাই এগিয়ে আসবেন এবং সেই মধ্যবিত্ত সমাজের গঠন হয় মূলত অর্থনৈতিক অভিযোজনের ফলে।
এই নিরিখে উত্তরবঙ্গে ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক অভিঘাত কিঞ্চিৎ ফিকে ছিল দক্ষিণবঙ্গের তুলনায়। দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গের ইতিহাস রচনায় ঐতিহ্যগতভাবে খামতি ছিল বা এখনও আছে, তার উত্তর এর মধ্যেই খানিকটা হলেও পাওয়া যাবে। ঔপনিবেশিক উদ্যোগে নগরায়ণ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, আঞ্চলিক ইতিহাসের ব্যাপ্তি ইত্যাদি লক্ষণ যতটা দক্ষিণবঙ্গে ছিল ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে, উত্তরবঙ্গে ততটাই ফিকে ছিল।
মহানগরীতে বাস করার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, রাজ্য লেখ্যাগারের সুযোগসুবিধা যা পাওয়া যায়, তা স্বভাবতই কোচবিহারে, জলপাইগুড়িতে, শিলিগুড়িতে, মালদায় বসে পাওয়া সম্ভব না। দার্জিলিং জেলা নিয়ে কাজ করতে চাইলে ডিএম অফিসে সংরক্ষিত দলিল, দস্তাবেজ ছানবিন করতে হবে, শুনলাম অবস্থা ভালো নয়। অবসরপ্রাপ্ত এডিএম জানালেন, ক্যাম্পবেলের ডায়ারিও উধাও! ভাবা যায়! আবার এও বন্ধুমহলে শুনি মহানগরীর অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য লেখ্যাগার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে ছানবিন করার উদ্যোগেও আলস্য আছে।
হাতের কাছে এত অফুরান আয়োজনকে এড়িয়ে যাওয়ার মাশুল অনেক। উত্তরবঙ্গের ইতিহাস চর্চায় যদি পিছিয়ে যাওয়া শহরকে চিহ্নিত করা যায়, তার মধ্যে অবশ্যই শিলিগুড়ি এগিয়ে। যে শহরের ঐতিহ্য বলতে খালি টাউন স্টেশন, আনন্দময়ী কালীবাড়ির মতো অতি মুষ্টিমেয় কিছু স্থাপত্য এবং রাজানুগ্রহ/জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে গোড়া থেকেই বঞ্চিত, সেখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভিয়েনেও ফিকে রং থাকবে।
সুতরাং যাঁরা শিলিগুড়ির ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বৃহৎ ভাবনার শরিক হতে চান, প্রতিপদে ঠোক্কর খেতে হবে। যৎসামান্য কাঠের বাড়িগুলোর সামনে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করি, কী মূর্খতায় জীবন আগে কাটিয়েছি! যখন বসন্ত ঘোষ, চোমং লামা, প্রদ্যুৎ বসু, নানু মিত্ররা জীবিত ছিলেন, কেন সাক্ষাৎকারটা অন্তত নিয়ে রাখলাম না! অথবা হৃদয়ে দার্জিলিং জেলার রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে বড় কাজ করার ইচ্ছাপোষণ করে গেলাম কিন্তু পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকের উত্তাল আন্দোলনের সাক্ষীরা যখন জীবিত ছিলেন, আজ যাব কাল যাব বলে কালক্ষেপ করলাম।
রাজ্য এবং জাতীয় লেখ্যাগার ঘেঁটে, পুলিশি ফাইল পর্যবেক্ষণ করে এবং অবশ্যই তৎকালীন ঘটনার সাক্ষীদের সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতার ভিয়েনে গড়ে ওঠে জনপদের কিসসা। শিলিগুড়ির ইতিহাসে দুটি ফাঁক পূরণ করার জন্য কেউ এগিয়ে এলে ভালো হয়। মস্তানদের এবং পতিতাদের কাহিনী। এক সময়ে হায়দরপাড়া, আশ্রমপাড়াতে কী ত্রাসের রাজত্ব ছিল তা জানি। এদের উদ্ভব, বিস্তার নিয়ে লেখা খুব জরুরি ডিআইবি, পুলিশি ফাইল ঘেঁটে। সমাজ মানে উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত সালতামামি না, নিম্নবর্গের ইতিহাসও জরুরি। বহুযুগ আগে শিখিয়েছিলেন আরেক মাস্টারমশাই ইপি থম্পসন, যাঁর এই বছর একশো হল।
(লেখক মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক)