শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

লোকসভার ভোট প্রচার চলছে, না পঞ্চায়েতের?

শেষ আপডেট:

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

হাত এত নাড়তে হচ্ছে, যে একটা সময় মনে হয়, হাত খুলে বেরিয়ে যাবে। ডানদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন। বাঁদিকে তাকিয়েও। উপরে তাকিয়ে। নীচে তাকিয়ে। এ ভাই, জরা দেখকে চলো, আগে হি নেহি পিছে ভি।

এই না হলে বড় দলের ভোট প্রার্থী!

ভালো এক্সারসাইজ কিন্তু। লিখতে লিখতে আমিই দৃশ্যগুলো কল্পনা করে, ল্যাপটপে টাইপ বন্ধ করে প্রার্থীসুলভ হাত নেড়ে নিই। দেখি তো কেমন লাগে!

এই সময় ভোট প্রার্থীদের অবস্থা হয় কলকাতার বাসের কনডাক্টরের মতো। কনডাক্টরদের এত টিকিট কাটতে হয় যে রাতে ঘুমানোর সময়ও অজান্তে হাত নাড়িয়ে যান। এই প্রার্থীরাও হয়তো ঘুমের মধ্যে ওইভাবে হাত নাড়ান! প্রণাম করতে থাকেন বুকের কাছে হাত এনে।

কত কী যে করতে হয়! গৌড়বঙ্গের মহিলা প্রার্থী দেখলাম, বাজারে গিয়ে মহিলা বিক্রেতাকে তুলে দিয়ে সেখানে বসে সবজি বিক্রি করছেন। উই ব্বাস। ইউনিক আইডিয়া। বাটখারা নিয়ে ওজন করতে হবে। কী ভাগ্যি, মাছের বাজারে গিয়ে মাছ কাটার কাজটাও তুলে নেননি। এতদিন যে প্রার্থী জীবনে ক্রিকেট ব্যাট ধরেননি, ফুটবলে পা দেননি, তিনি সটান মাঠে গিয়ে ব্যাট হাতে নেমে পড়ছেন। কোহলি! কোহলি! পা দিয়ে বল মারছেন। মেসি! মেসি! চারপাশের গুণমুগ্ধরা হাততালি দিয়ে উঠছেন।

জীবনে যা করেননি, তা গিয়ে করতে হবে এবার। ভিড়ের মধ্যে মায়ের কোলে সিকনি পরা শিশুকে দেখে সহাস্য কোলে তুলে নিতে হবে। বাচ্চা মেয়েকে পড়তে দেখে,  নিয়ে নিতে হবে পড়াশোনার ক্লাস। কীর্তনের আসরে গিয়ে ফুলের মালা গলায় পরে ‘সখী গো…’ বলে দু’হাত তুলে বেসুরো গাইতে হবে। ঘাড়ে নিয়ে কষ্ট হলেও বাজাতে হবে খোল। কীর্তনিয়ার পর বাউল হব, হাতে নেব দোতারা। গান গাইতে হবে। চা বানাতে হবে। মোমোও। যে লোকটা এতদিন দেখা করতে গেলে, বাইরে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করিয়ে রাখা হত, তাকে দেখামাত্র রাস্তায় ছুটে যেতে হবে, ‘ভাই, ভাই এলি রে?’ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখার প্র্যাকটিস করতে হবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।

ইনস্টার রিলসে এখন তিনটি জিনিসের ট্রেন্ড। আফ্রিকানদের দেশের নাম নিয়ে শিক্ষা, ফুটবল ম্যাচে বাচ্চাদের অদ্ভুত গোল করার স্টাইল, গ্যাসের স্টোভ থেকে ঝাঁটা, ঝাড়ু দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে গান গাওয়া। ভোটের প্রচারের কিছু রিলস এসবকেই ছাপিয়ে যাবে হাসির খোরাক হিসেবে। আপনি বিকট সুরে গাইবেন, ফান্দে পড়িয়া বগা…। কখনও ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না মুঝে’।

কেউ প্রার্থীকে প্রশ্ন করে না, একদিন পড়িয়ে, একদিন সবজি বিক্রি করে লাভ কী? হবু সাংসদরা এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, ফেসবুক-ইনস্টার ছবির কথা ভেবে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন প্রচার, এবার কাউন্সিলার-পঞ্চায়েত প্রধান হতে ইচ্ছুকদেরও ভাবতে হবে, নতুন কী স্টাইলে প্রচার করা যায়? লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীরা এবার যা করছেন, তা অতীতে গ্রামীণ ভোটে দেখা যেত। পঞ্চায়েতে বা পুরসভায়। কথাবার্তাতেও চলে আসছে মস্তান সুলভ বারফট্টাই। লোকসভার প্রচারেও যে এমন আভিজাত্যহীন ছ্যাবলামির হবে, তা স্বপ্নের অতীত ছিল অনেকের। তাঁরা এখন থেকেই ভাবছেন, কী করি, কী করি এখন। আর ফলে হয়েছে কী, যে আসলে পঞ্চায়েত প্রার্থী হওয়ার যোগ্য, সেও ভাবছে, আমি কেন লোকসভায় প্রার্থী হব না?

দাদা-দিদিদের অধিকাংশেরই সকাল শুরু হচ্ছে মন্দির-মাজার-গির্জায় গিয়ে। এবার ধর্ম এবং মহিলা ভোট একটা ইস্যু। তাই কোনও ধর্মস্থানে নট ছাড়নছাড়ন। শীতলা থেকে শনি মন্দির, কোথাও বাদ দেওয়া চলবে না। সাতসকাল থেকে প্রণাম শুরু। এবং বাংলায় এখন প্রণাম করলেই পুরোহিত উত্তর ভারতীয় স্টাইলে কপালে একটা বড় সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে দিচ্ছেন। সিঁদুরের টিপের পর সিঁদুরের টিপ-একেবারে রঘু ডাকাতের মতো লাগছে অনেককে। অথচ কিছু করার নেই। ভোট বড় বালাই স্যর।

বিকেলে পাড়ার সুইমিং পুলে কচিকাঁচার সঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে দিলেন প্রবীণ প্রার্থী। উৎপল দত্ত স্টাইলে বললেন, কী আনন্দ! মুসলিম ভোট পেতে মাথায় ফেজটুপি পরে ইফতারে বসে যেতে হচ্ছে সন্ধ্যায়। গ্রামে ঘোরার ফাঁকে কোনও মহিলার বাড়ি গিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় স্টাইলে বলতে হচ্ছে, মাসিমা তরকারি খামু। জানি, পুঁই শাকের তরকারি। ডাক্তার খেতে বারণ করেছেন। তবু খেতে হবে। কেউ গুগলির ঝোল খেয়ে বলছেন, অমৃত। কোনওদিন ঘোমটা দেন না, লম্বাহাতা ব্লাউজ পরেন না। এখন সে সব বাধ্যতামূলক। শাড়ি তো পরতে হবেই।

করতে তো অনেক কিছুই হবে ভাই। পুষ্পবৃষ্টির ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রার্থীর ওপর গাঁদা ফুলের পাপড়ির বৃষ্টি। এখানে সন্দেশখালি পথ দেখিয়েছে। শুধু দেবতাদের জন্য পুষ্পবৃষ্টি হলে চলবে? অত জ্বালা-যন্ত্রণা, অত প্রতিবাদ- তার মধ্যেও সন্দেশখালিতে রাজ্যপালের মাথায় পুষ্পবৃষ্টির ব্যবস্থা হয়েছিল। ভালো কথা। রাজ্যপাল বলতে মনে পড়ল। রাজা না দেওয়ান, কার মূর্তিতে মালা দিচ্ছি, সেটা না জেনেই মালা পরিয়ে দিতে হবে। স্থানীয় নেতারা যখন বলেছেন, তখন ইনি কেউ কেউকেটা হবেন। মালা পরিয়ে ছবি তো আগে তুলে নিই!

মাইন্ড ইট, লোকাল নেতাদের চটালে চলবে না। আপনি জানেন, এই লোকটি আপনার পাশে পাশে ফেভিকলের মতো জুড়ে থাকলেও অবধারিত আপনার পিছনে লাগছে। সে প্রার্থী হতে চেয়েছিল। হতে পারেনি বলে আপনাকে হারানোর চেষ্টা করছে আসলে। ভোটের দিন সাবোতাজ করবেই। তবু তার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে হবে। হেঁ হেঁ দাদা, আপনি যা করছেন না আমার জন্য… কী করে যে ধন্যবাদ দিই। ইনি পালটা বলবেন, না, না, এ আর এমন কী। আপনি যা খাটছেন না, কাউকে এত খাটতে দেখিনি!

সংলাপ শুনলে গ্রামের পথে পদাবলি কীর্তন মনে পড়বে। কীর্তনিয়া বলছেন, ‘রাধা বলছেন, ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না শ্যাম’। আসলে তিনি বলতে চাইছেন উলটোটা। ছুঁয়ো। না, ছুঁয়ো। না, ছুঁয়ো। বলছেন একটা কথা। বলতে চাইছেন আসলে অন্য কথা।

আরও একটা টিপস। এখন সব প্রার্থীর সম্পত্তির হিসেব দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যাবেন পিসি সরকার পর্যন্ত। এ কোন ম্যাজিক? অধিকাংশ প্রার্থীরই নাকি আয় কমে গিয়েছে। কেন্দ্রে মন্ত্রী পাঁচ বছর। সাংসদ ১০ বছর। তাঁদেরও নাকি সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য কমে গিয়েছে। সবারই দেখা যাচ্ছে কলকাতায় ফ্ল্যাট রয়েছে। অথচ সে ফ্ল্যাটের জলের দরে দাম। এত সস্তায় কলকাতায় ফ্ল্যাট মেলে কোথায়, কে জানে! যেসব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এঁদের হিসেব বানিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের প্রাইজ মাস্ট। আসলে সব প্রার্থী বুঝে গিয়েছেন, মনোনয়নপত্র পেশের পরেই লোকে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর বিষয়-আশয় পাঁচ বছরে কত বাড়ল, তার হিসেব দিতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হবে। তাই এমন কিছু করো, যাতে আয় বাড়ানোর হিসেব লোকে বুঝতে না পারে।

তবে একটা কথা ভেবে মাথা চুলকে যাই। উত্তর মেলে না। মন্ত্রী-সাংসদ-নেতাদেরই যদি আয় এভাবে কমে যায়, তাহলে দেশের উন্নতি হচ্ছে কী করে? সাধারণ মানুষেরও কি আয় এভাবে কমে যাচ্ছে? পঞ্চায়েত, পুরসভা, কনট্রাক্টরি, কাউন্সিলারগিরি করে ফুলেফেঁপে ওঠা নেতারা এখান থেকে আয় লুকোনোর একটা বড় টিপস নিতে পারেন। জানেনই তো, মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন/ হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,/ সেই পথ লক্ষ্য করে, স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে/আমরাও হব বরণীয়।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

জমি মানেই খাঁটি সোনা, রামরাজ্যে হরির লুট

 আশিস ঘোষ ‘রাম রাজ বৈঠে ত্রিলোকা/ হর্ষিত ভয়ে...

রিজিওনাল স্কুল সার্ভিস কমিশন ফিরুক

মৈনাক কুন্ডা উন্নয়নের এক অমোঘ প্রশ্ন চিরকালীন। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ...

আশ্বাস যেন শিক্ষকদের উপহাস না হয়ে ওঠে!

গৌতম সরকার ধম্মে সইবে না। সইছেও না। শিক্ষকের গায়ে হাতে তাই...

বহিরাগত তত্ত্ব ও গুজব উদ্বেগের বড় কারণ বাংলায়

রূপায়ণ ভট্টাচার্য বহিরাগত মানে আপনি ঠিক কী বোঝেন? অভিধান ঘাঁটলে দুটো...