গৌতম হোড়
নয়াদিল্লির রাস্তায় ঘোরাঘুরি করলে একটা জিনিস অত্যন্ত স্পষ্ট বুঝতে পারি। গত সাত বছরের মধ্যে এবারই জনপ্রিয়তার বিচারে নরেন্দ্র মোদি সবচেয়ে নীচে। আগের বারের মতো জনপ্রিয়তা নেই। কিন্তু কনট প্লেস, চাঁদনি চক, আইটিও, রাজেন্দ্রনগরের মতো সব জায়গায় লোকের সঙ্গে কথা বললে একটা তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নিজস্ব জনপ্রিয়তার গ্রাফে নীচে থাকলেও, মোদি অন্য সব নেতাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে বিজেপি নেতা বা কর্মীরা ধরে নিয়েছেন, মোদি তাঁদের ২০২৪-এর ভোট যাত্রাও পার করে দেবেন। মোদি বলতে তাঁরা অজ্ঞান আজও।
রাজধানীতে আমি রয়েছি নরসীমা রাওয়ের আমলের শেষ দিক থেকে। কম প্রধানমন্ত্রী এই কয়েক বছরে দেখলাম না। অটলবিহারী বাজপেয়ীকে মাথায় রেখেও বলছি, জনপ্রিয়তায় সব প্রধানমন্ত্রীকে ছাপিয়ে গিয়েছেন মোদি।
মোদি এবং বাজপেয়ীর মধ্যে ফারাকটা কোথায়? বাজপেয়ী সরকার তখন ছিল অনেকটা নড়বড়ে। মোদি কিন্তু দুবার দেশের ক্ষমতায় এসেছেন নিজস্ব দাপটে। তাঁকে আপনি ঘৃণা করতে পারেন, নানা নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না। এতটাই দাপট।
বাজপেয়ীর সময় দেখেছি, তিনি অনেকটা পুরোনো কংগ্রেসি ঘরানার। সবাইকে নিয়ে চলতে পারতেন। বিরোধীদেরও। সোনিয়া গান্ধি পর্যন্ত তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। একবারই দেখেছি লোকসভায় বাজপেয়ীকে আক্রমণ করতে। সেখানে সোনিয়া-মোদির তো বাক্যালাপই বন্ধ। মোদিও যেমন কট্টর, তেমন তাঁর বিরোধীরাও কট্টর। বাজপেয়ীকে কিন্তু বিরোধীরা ভালোবাসতেন। বাজপেয়ী কংগ্রেসি ঘরানার বলেছি, অনেকটাই গণতান্ত্রিক। মোদি সেখানে রুথলেস, যে করেই হোক জেতার ব্যাপারে মরিয়া। বাজপেয়ী আবার সব সময় রাজনৈতিক স্বার্থ দেখতেন না। অনেক বিরোধী নেতাকে বিপদে ফেলার সুযোগ পেয়ে তাঁদের ছেড়ে দিয়েছেন। মোদির আমলে যা ভাবাই যায় না।
সব মিলিয়ে গত কুড়ি বছর ধরে মোদি ক্ষমতায়। প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর গত সাত বছরের মার্কশিট বানাতে বসলে এ রকম দেখা যাচ্ছে।
১. ক-এ করোনা আসছে তেড়ে
করোনা যে তেড়ে আসছে, পরিস্থিতি যে এর ফলে ভয়ংকর হতে পারে, সেই উপলব্ধিটা মোদি সরকারের একটু পরে হয়েছিল। চিন ও পশ্চিমের দুনিয়ায় করোনার তাণ্ডব শুরুর অনেক পরে। এই ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে সরকারের সচেতনতা প্রথমে কম ছিল। আহমেদাবাদে নমস্তে ট্রাম্প নিয়ে সরকার ব্যস্ত। যখন চেতনা হল, তখন হঠাৎ মানুষকে সময় না দিয়ে লকডাউন ঘোষণা করা হল। সবচেয়ে বিপদে পড়লেন পরিয়ায়ী শ্রমিকরা। মাইলের পর মাইল হেঁটে আসতে গিয়ে পথের মাঝে মারা গিয়েছেন, ট্রাক বা বাস থেঁতলে দিয়েছে তাঁদের শরীর, সেই স্মৃতি এখন সময়ে প্রলেপে ক্রমশ ফিকে হচ্ছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছিল আরও মারাত্মক। গঙ্গা দিয়ে বয়ে আসা শব, উত্তরপ্রদেশে বালিতে পুঁতে রাখা লাশ, অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু, হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ার ঘটনা, শ্মশানে, কবরস্থানে লম্বা লাইন দেশকে তীব্র ধাক্কা দিয়েছে। করোনাকালে নিজামুদ্দিনের অনুষ্ঠান থেকেও সরকার শিক্ষা নেয়নি। কুম্ভমেলা হয়েছে, কোটি কোটি মানুষ সেখানে গিয়ে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর কাজ করেছেন। করোনা মোকাবিলায় মোদিকে খুব বেশি নম্বর দেওয়া যাচ্ছে না।
২. টিকা নিয়ে করোনা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের নিরিখে করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত দেরি করেনি, বরং অনেকের তুলনায় এগিয়ে ছিল। খুব তাড়াহুড়ো করে কোভ্যাকসিনকে অনুমোদন দেওয়া এবং মাঝে কিছুটা সময় টিকার আকালের ঘটনা বাদ দিলে ভারতে এখন টিকাকরণ গতি পেয়েছে। প্রাথমিক জড়তা ঝেড়ে ফেলে মোদি সরকারি পয়সায় টিকার ব্যবস্থা করেছেন। সরকারি টিকাদান কেন্দ্রে টিকা নিতে মানুষের এক পয়সাও খরচ নেই। ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে টিকাদান কর্মসূচি মসৃণভাবে চলেছে। এর জন্য মোদি নিঃসন্দেহে ভালো নম্বর পাবেন।
৩. গরিবদের সাহায্য
করোনাকালে কর্মসংস্থান হারিয়ে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন গরিবরা। দিনের পর দিন লকডাউন থেকেছে। অত্যন্ত জরুরি ক্ষেত্রগুলি ছাড়া সব বন্ধ। ফলে গরিবদের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকার লকডাউনের সময় প্রথমে গরিবদের অ্যাকাউন্টে পাঁচশো টাকা দিয়েছে। তারপর প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ প্রকল্পের আওতায় গরিবদের বিনা পয়সায় রেশন দেওয়া হচ্ছে।
কৃষকদের আগে থেকেই বছরে ছয় হাজার টাকা দিচ্ছেন মোদি। করোনাকালে গরিবদের এইভাবে সাহায্য করাটা খুবই জরুরি ছিল। সেই কাজটার চেষ্টা করেছেন মোদি। এটা সাফল্য তো বটেই। তবে আরও সাহায্যের প্রত্যাশা থেকেই যাচ্ছে।
৪. শিল্পক্ষেত্রের অবস্থা
গত সাত বছরে ভারতে অর্থনীতি ও শিল্পক্ষেত্রের অবস্থা নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে করোনার প্রকোপ বাড়ার পর তার প্রভাব ভয়ংকরভাবে পড়েছে শিল্পে। সরকার বেশ কয়েকবার প্যাকেজ নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই প্যাকেজ ছিল বেশিরভাগই ঋণনির্ভর।
সেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোটা করোনাকালে কতটা কঠিন তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন ছোট ও মাঝারি শিল্পের মালিকরা। ফলে অধিকাংশ শিল্পে কর্মীসংকোচন হয়েছে। বেতন কমে গিয়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। বৃদ্ধির হার নেতিবাচক। এখন অবশ্য তা কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা নেই বলে বাজার মন্দা। পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। শিল্পক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি মোদি।
৫. স্বাস্থ্যের হাল
করোনা একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তা হল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেহাল অবস্থা। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অপ্রতুল। তবে মোদি এর মধ্যে একটা ভালো জিনিস করেছেন। তা হল আয়ুষ্মান ভারত। গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিমা করে দেওয়া। তার জন্য এক পয়সাও দিতে হচ্ছে না গরিবদের। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের সকলের জন্য স্বাস্থ্যসাথী করে এক্ষেত্রে মোদিকে টেক্কা দিয়েছেন।
৬. সাম্প্রদায়িক স্থিতি
করোনাকালেই সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর দাঙ্গা দেখেছে দিল্লি। রাজধানীতে এমন সাম্প্রদাযিক উত্তেজনা, হত্যা, আগুন, আক্রমণের ঘটনা ছিল কল্পনাতীত। ভাবলে শিউরে উঠি আজও। মোদির মেরুকরণের রাজনীতি, বিভাজনের প্রয়াস নিয়ে প্রচুর সমালোচনার ঝড়।
৭. বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার
গত সাত বছরে একের পর এক রাজ্যে বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়েছে বিজেপি। কর্ণাটকে কংগ্রেস, জেডিইউ বিধায়কদের ভাঙিয়েছেন। একই ঘটনা মধ্যপ্রদেশে। আগে উত্তর-পূর্বের রাজ্যে এটা ঘটেছে। বিধানসভা ভোট এলে একটা কথা চালু এখন। যেই জিতুক, সরকার গড়বে বিজেপি। একটা সময় কংগ্রেস এই কাজ করেছে। পরে কিছু আঞ্চলিক দলও বিধায়ক ও সাংসদ ভাঙিয়েছে। এখন বিজেপি করছে।
৮. কাশ্মীরের সিদ্ধান্ত
গত সাত বছরে মোদির অন্যতম সাহসী ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হল, জম্মু ও কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা। জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্য থেকে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা। এখনই কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। লাদাখ বিতর্ক, আফগানিস্তান, চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
জন্মদিনে মোদির কাজের মার্কশিট হয়তো ভালো দেখাবে না, কিন্তু জনপ্রিয়তায় তিনি আজও অনেক এগিয়ে
(লেখক সাংবাদিক)