রন্তিদেব সেনগুপ্ত
ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে বিকল্প জোটের নেতৃত্বে কে? কংগ্রেস, নাকি অন্য কেউ? সোনিয়া এবং রাহুল গান্ধি নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? লোকসভা নির্বাচনের এখনও যখন দুবছর বাকি, তখন জাতীয় রাজনীতিতে এই প্রশ্নটি ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে এবং এই প্রশ্নে ইতিমধ্যেই বিরোধী জোটে একটি সূক্ষ্ম ফাটল ধরা পড়ছে। ভবিষ্যতে এই ফাটল আরও চওড়া হবে কি না, সে বিষয়টি যত দিন গড়াবে পরিষ্কার হবে। কিন্তু এটুকু এখন পরিষ্কার যে, বিরোধী জোটের নেতৃত্ব কে দখলে রাখবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব তাড়াতাড়ি মেটার সম্ভাবনা খুবই কম।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে অকল্পনীয় সাফল্য লাভের পর তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে অস্বীকার করে একটি বিরোধী জোট গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। কংগ্রেসকে কার্যত বাদ রেখেই একটি জোট তিনি গড়ে তুলতে চান, এখনও পর্যন্ত তাঁর প্রচেষ্টায় সেটাই স্পষ্ট। অন্যদিকে কংগ্রেসের ভিতরে শুধু নয়, কংগ্রেসের বাইরেও একটি মতামত স্পষ্ট উঠে আসছে যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট কোনওমতেই সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকলেও শারদ পাওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপি দল এবং উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা আলাদাভাবে জানিয়েছে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোটের কল্পনা করা ঠিক হবে না। এখন যত দিন যাবে, তত দিন এই প্রশ্ন আরও উঠে আসবে যে, ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির মতো একটি শক্তির বিরোধিতায় কংগ্রেস কি সত্যিই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, না, কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা পূর্বে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে?
একথা মানতেই হবে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির যথায়থ মোকাবিলায় এই মুহূর্তে সফলতম মুখটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রবল বিজেপি ঝড় সামলে যেভাবে তিনি নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শা-কে পত্রপাঠ বিদায় করেছেন- তারপর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মবিশ্বাস অনেকখানিই বেড়ে গিয়েছে। জাতীয়স্তরেও তাঁর এই সাফল্য এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে মমতা বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এমন একটি বিরোধী জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় মন দিয়েছেন, যে জোটের নেতৃত্বের রাশটি তাঁর হাতেই থাকবে। এটি তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ এটি মানতেই হবে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকাও অন্যায়ের কিছুই নয়। যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। আর বিধানসভা নির্বাচনের পরে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বের আসনে আসীন হয়ে বিরোধী জোটের নেতৃত্বের রাশ হাতে নেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর ভিতরে যদি দেখা যায়, সেটাও দোষের নয়। মমতা এটাও জানেন, এই বিরোধী জোটের নেতৃত্ব যদি তাঁকে হাতে নিতে হয়, তাহলে কংগ্রেসকে অস্বীকার তাঁকে করতেই হবে এবং সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসকে ভেঙে দিতে তিনি তৎপর।
মমতার হিসেবটি খুব সহজ। তিনি মনে করছেন, বিরোধী জোটের নেতৃত্বে তিনি যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাহলে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁর নামই উঠে আসবে। তারপর শিকে ছিঁড়বে কি ছিঁড়বে না সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা, আপাতত নরেন্দ্র মোদির বিকল্প হিসাবে তাঁর নামই উচ্চারিত হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মমতার এই রাজনীতিতে লাভবান কে হবেন?
একথা ঠিক, রাহুল গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধী জোটকে কোনও দিশা দেখাতে পারেনি। রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরেই প্রশ্ন রয়েছে। রাজনীতিতে রাহুল কতখানি আন্তরিক বা আদৌ আন্তরিক কি না সে সংশয়ও সকলের ভিতরই রয়েছে। একথাও ঠিক, রাহুলের নেতৃত্বের এই ব্যর্থতাই বিজেপিকে দিল্লির ক্ষমতায় টিকে থাকতে অনেকখানি সাহায্য করছে এবং রাহুল নেতৃত্বে আছেন বলেই কংগ্রেস সম্পর্কে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে মমতা বিকল্প বিরোধী জোট গঠনের আহ্বান জানানোর সুযোগটি পেয়ে গিয়েছেন।
এসব সত্য হলেও এটা কখনোই বলা যাবে না, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। জাতীয় কংগ্রেস এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠন, হাজার দুর্বলতা সত্ত্বেও যার শিকড় কমবেশি এখনও দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রোথিত। যা কোনও আঞ্চলিক দলের নেই। সংসদের আসন সংখ্যা দিয়ে কংগ্রেসের এই গুরুত্বখানি হয়তো বোঝা সম্ভব নয়। কংগ্রেসের এই গুরুত্বটি সবথেকে ভালো বোঝে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। জানে বলেই কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার একটি ডাকও বিজেপি দিয়েছিল। কংগ্রেস না থাকলে আঞ্চলিক দলগুলিকে মোকাবিলা করা যে খুব কষ্টসাধ্য নয়, এ হিসাব বিজেপি নেতৃত্বের করা আছে। কাজেই আজ যদি কেউ কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট গঠন করার কথা বলেন, সেক্ষেত্রে সবথেকে আনন্দিত হবেন বিজেপি নেতৃত্ব এবং সম্ভবত এখন সেই আনন্দই তাঁরা উপভোগ করছেন।
এখন বোঝার যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে এমন একটি বিরোধী জোটের প্রক্রিয়া জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের সামনে কী ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। প্রথমত, কংগ্রেসকে দূরে রাখলে জাতীয় রাজনীতির ভারসাম্যটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই রাজনৈতিক ভারসাম্যটি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে জাতীয়স্তরে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির আত্মপ্রকাশ আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক শক্তির পরিসরও কমে আসবে। তাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির আখেরে কোনও লাভ হবে না। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে প্রথম বিকল্প, দ্বিতীয় বিকল্প বা তৃতীয় বিকল্পতে যতই বিভক্ত হয়ে পড়বে বিরোধী দলগুলি, ততই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী ভোট আরও বেশি বিভাজন হয়ে পড়বে। আর তাতে লাভ কার? এটা বোঝার জন্য অন্তত ভোটকুশলী হওয়ার কোনও প্রয়োজন হয় না।
কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে একটি বিরোধী জোট গঠনের ভিতর যে বিপজ্জনক ইঙ্গিতটি আছে, মনে হচ্ছে, বিরোধী নেতারা তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এখনও পর্যন্ত কিন্তু মমতার এরকম একটি প্রস্তাবে সেভাবে সাড়া বিরোধী নেতারা দেননি। বরং, মমতার মুম্বই সফরের পর শারদ পাওয়ারের এনসিপি এবং উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এরকম জোটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
অবশ্য মমতার পেশাদারি পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর নানাবিধ পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোটের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে মনে রাখতে হবে, প্রশান্ত কিশোর কোনও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতি করেন না। তিনি একটি বেসরকারি পরামর্শদাতা সংস্থার মালিক, যাঁরা বাছবিচার না করে পয়সার বিনিময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বুদ্ধি বেচেন। অর্থের বিনিময়ে তাঁর বুদ্ধিতে মমতা ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা হয়তো চালিয়ে যাবেন, কিন্তু শেষ বিচারে এই প্রশ্নও যে উঠবে, মমতা, তুমি কার?
(লেখক সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার)