প্রবীর ঘোষাল
২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে ২৪ ঘণ্টা আগে। পরের দিন বিকালে প্রতিদিনের মতো সাংবাদিকরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে হাজির। সিপিএমের হেডকোয়ার্টার তখন যুদ্ধ জয়ে আনন্দ উত্সবে মাতোয়ারা। আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে ৬ লক্ষেরও বেশি ভোটে জয়ী অনিল বসু এলেন পার্টির সদর দপ্তরে। দেশের মধ্যে রেকর্ড, সর্বোচ্চ ভোটে জিতেছেন। অনিলবাবু সেদিন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে উষ্ণ অভ্যর্থনাও পেলেন। সিপিএমের তদানীন্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস সেদিন গর্ব করে আমাদের বলেছিলেন, অনিলের ক্ষমতা আছে, দেখিয়ে দিয়েছে, জনগণ কীভাবে আমাদের পাশে আছে।
দৃশ্যটা আবার মনে পড়ে যাচ্ছে ত্রিপুরায় পঞ্চায়েত ভোটের একতরফা ফল দেখে। এইভাবে বিজেপির ৯৯ শতাংশ আসনে জয়ে মনে উঁকি মারছে অনেক অতীত ভোটের ছবি। এবং সহজ একটা সত্যি। রিগিং করে জিতে সাময়িক লাভ হতে পারে। দীর্ঘ সময়ে লাভ কিছুতেই হতে পারে না। একসময় মানুষ ভোট দিতে না দেওয়ার শোধ তুলবেই। এই ব্যাপারটা ত্রিপুরা লাগোয়া বাংলায় সিপিএম দেখেছে, তৃণমূলও দেখেছে। সব রাজ্যেই এই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত। ৯৯ শতাংশ আসনে জয় ব্যাপারটা হাস্যকর।
রিগিং শব্দটা বাংলা প্রথম শোনে ১৯৭২ সালে। কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর। অতীতে ছয়ের দশকে বামপন্থীরা সন্ত্রাসের সাহায্য নিয়েছিল ভোটে জিততে। কিন্তু ১৯৭২ সালের রিগিং ব্যাপারটা নিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়। তখনকার প্রচলিত গল্প কত সত্যি বলা কঠিন। তবে বামফ্রন্টের ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় ফেরার ক্ষেত্রে পুরোনো রিগিং একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
২০০৪ সাল দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। জাম্পকাট করে চলে যাই ২০১১ সালে। বিধানসভা ভোটে বাংলায় বামফ্রন্ট শুধু ক্ষমতাচ্যুতই নয়, শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্তও হল। তখন অবশ্য অনিল বিশ্বাস বেঁচে নেই। জীবিত থাকলে তিনি বুঝতে পারতেন একটা সত্য। শুধুমাত্র ২০০৪ সাল কেন, আগের বেশ কয়েকটি লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় সিপিএম বা বামফ্রন্টের জয়ের নেপথ্যে জনগণ নয়, রিগিং নামক স্বৈরাচারী একটি বিষাক্ত অস্ত্রের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। অনিল বসু অস্বাভাবিক মার্জিনে জিতলেন, সেবারও লালপার্টির রেকর্ড কেরামতি ছিল ভোটবাক্সেই।
২০০৪ সালে লোকসভা ভোটের পর এ রাজ্যের সন্ত্রাস এবং রিগিং নিয়ে একটি বই লিখেছিলাম। বইটির নাম ছিল সিপিএমের রিগিং। ২০-২২টি লোকসভা কেন্দ্রের বুথভিত্তিক ফল তুলে ধরে বোঝাতে চেয়েছিলাম, ভোটের নামে গাঁ-গঞ্জে কী ধরনের কারচুপি এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল সিপিএম। মাঝে বৈজ্ঞানিক রিগিং কথাটা খুব শোনা যেত। এ শব্দটা তৈরি বিশিষ্ট সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তের। সারাবছর সন্ত্রাস দেখিয়ে ভোটের সময় কিছু করা হত না। তবে ভোটার লিস্ট তৈরি থেকে ভোট গোনা পর্যন্ত মসৃণভাবে বিরোধী ভোটারদের ছেঁটে ফেলা হত। লোকে দেখত, শান্তিপূর্ণ ভোটে বামফ্রন্ট জিতে বেরিয়ে গেল।
১৯৮৮ সালে ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। সেখানেও বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের সামনে দুর্নীতি ও অত্যাচার বল্গাহীন চেহারা নিয়েছিল। নৃপেন চক্রবর্তী-দশরথ দেবদের হাতে গড়া পার্টির বিরুদ্ধে ত্রিপুরায় সর্বত্র জনমনে ক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু সন্ত্রাস এবং রিগিংকে সম্বল করে সিপিএম একের পর এক নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছিল। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমান্ড, তথা কেন্দ্রের তত্কালীন শাসকদল সিদ্ধান্ত নিল, ত্রিপুরাকে লাল সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্ত করবে। অসমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেস নেতা সন্তোষমোহন দেবকে তারা ক্যাপ্টেন করে টিমকে মাঠে নামিয়ে দেয়। বর্তমানে ত্রিপুরায় জোড়াফুলের অন্যতম মুখ সুস্মিতা দেবের প্রয়াত পিতা তখন কেন্দ্রের ক্ষমতাবান মন্ত্রীও বটে। পরে বিধানসভার ভোটে সিপিএমের সব কারিকুরি হাওয়া হয়ে গেল। ত্রিপুরায় তাদের ক্ষমতাচ্যুত হতে হল জনতার রায়ে
একই ছবি পশ্চিমবঙ্গেও। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিধানসভা ভোটে রিগিং-সন্ত্রাসের কী দাপট! সেইসঙ্গে সিপিএম নেতা-মন্ত্রীদের আত্ম-অহংকার। সেবার বিধানসভা ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হুংকার আজও কানে বাজে। আমরা ২৩৫, ওরা ৩০! বিরোধীরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাথা ভেঙে দেওয়া হবে ইত্যাদি। তারপর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে বুদ্ধদেববাবুদের কাণ্ডকারখানা তো বাংলার রাজনীতির একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। আসলে ক্ষমতার মসনদে বসলে শাসকের মাথা যে ঘুরে যায় দেশ-বিদেশের ইতিহাসে তার ভূরিভূরি নজির আছে। বুদ্ধদেব অ্যান্ড কোম্পানিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ইতিহাসের নিয়মে তাঁদেরও ঔদ্ধত্য এবং অত্যাচারের মাশুল দিতে হয়েছিল।
২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে আর বেশি নাড়াচাড়ার সুযোগ পায়নি সিপিএম। তাদের সাধের বামফ্রন্ট একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেল সেই তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলকে তাচ্ছিল্য করেই তো বুদ্ধদেববাবু ৫ বছর আগে বলেছিলেন মাথা ভেঙে দেব!
ত্রিপুরায় কংগ্রেসকে হারিয়ে ফের বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ফিরে আসে। এবারে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে রাজ্যের উন্নয়নে সেভাবে কিছুই করতে পারেনি তারা। আগের মতোই অত্যাচার আর দুর্নীতি বাঁই বাঁই করে বেড়েছে। শাসককুল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না বলেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় বারবার। ত্রিপুরাতেও হল। ৪ বছর আগে সিপিএম আবার ক্ষমতা থেকে চলে গেল। নয়া শক্তি হিসাবে ক্ষমতায় এল ভারতীয় জনতা পার্টি। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতত্ব ত্রিপুরায় দলের তরুণ তুর্কি বিপ্লব দেবকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নানা ভাইরাস দেখা দেয় ক্ষমতাসীন দলে। প্রায় ২০টি দপ্তর নিজের হাতে রেখে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পরিচালনায় বেশ কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েন। তাঁর আবোল-তাবোল কথাবার্তাও নানা সময়ে বিতর্ক তৈরি করে। নির্বাচনের সময় রাজ্যের উন্নয়ন এবং বেকারদের চাকরি সহ যেসব গালভরা প্রতিশ্রুতি বিজেপি ভোটারদের দিয়েছিল, তার প্রায় কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। উলটে দুর্নীতি এবং দমন-পীড়ন দুর্নিবার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই এক রোগ।
ত্রিপুরায় জনগণ থেকে যে পদ্মফুল ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল তা দৃশ্যত টের পাওয়া যাচ্ছিল। হালফিল ভোটে তাই বিজেপিকে পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। রিগিং এবং সন্ত্রাসকে ভোটে জেতার জন্য তাদের হাতিয়ার করতে দেখা গিয়েছে। গণতন্ত্রের পক্ষে যেমন এই প্রবণতা বিপজ্জনক, তেমনি শাসকের পক্ষেও ভবিষ্যতে বিপদের ইঙ্গিত।
২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের বাড়াবাড়ি সবাই দেখেছে। তার প্রতিফলন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঘটেছে। এরাজ্যে ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন জিতে বিজেপি চমক দেখায়। পরে সৌগত রায় থেকে শুরু করে অনুব্রত মণ্ডল, সবাই বলেছিলেন, আগের ভোটে কর্মীদের রিগিংয়েই মাশুল দিতে হয়েছে তৃণমূলকে। যাঁরা আগের ভোটে ভোট দিতে পারেননি, তাঁরাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে গিয়েছেন।
মমতা বুঝে যান, মানুষের মনে ক্ষতে প্রলেপ দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের নানা প্রকল্পের সঙ্গে প্রশাসন এবং দলীয় সংগঠনকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করে দেন তিনি। দিদিকে বলো থেকে শুরু করে দুয়ারে সরকার কর্মসূচির মতো বাস্তবসম্মত কার্যসূচির মাধ্যমে রাজ্যবাসীর কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বাড়াতে সক্ষম হন মমতা। এইভাবে সংগঠনকেও শক্তপোক্ত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোরের টিম। যার সুফল মেলে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে। বিরোধীদের উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়।
ত্রিপুরায় গায়ের জোরে পুরসভা-পঞ্চায়েতে রেকর্ড ভোটে জেতার এই অভিযানও কিন্তু বিজেপিকে আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে নিঃসন্দেহে অগ্নিপরীক্ষার মুখে ঠেলে দেবে। যেসব মানুষ ভোট দিতে পারেননি, তাঁদের মনের পুঞ্জীভত ক্ষোভ আছড়ে পড়তে পারে। অতীতে ত্রিপুরায় যে প্রবণতা বারবার দেখা গিয়েছে। বিপ্লব দেব এবং তাঁর সঙ্গীরা যদি মানুষের মনে আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদেরও চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
(লেখক সাংবাদিক ও প্রাক্তন বিধায়ক)